ঢাকা, রবিবার   ১৯ মে ২০২৪

‘শহিদের সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত’ 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৪, ৮ আগস্ট ২০১৯

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা শহিদ কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের কবল থেকে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার অসামান্য দায়িত্বনিষ্ঠার প্রতি সম্মান জানিয়ে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মরণোত্তর বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেন। 

সম্প্রতি কোয়াণ্টাম মেথডের এক কোর্সে অংশ নিয়ে এ শহিদের তনয়া চিত্রশিল্পী আফরোজা জামিল কংকা বঙ্গবন্ধু ও তার বাবাকে নিয়ে দুঃসহ সেই স্মৃতিগুলোর কথা তুলে ধরেছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ভোর হয়নি তখনো। শেষ রাতের দিকে ফোন বেজে উঠল। আম্মা ধড়মড় করে উঠে ফোনটা তুললেন। ওপাশ থেকে বঙ্গবন্ধুর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ: ‘জামিল কোথায়’? জামিলকে দে’। বঙ্গবন্ধুর কথার উত্তরে আব্বা বললেন: স্যার আমি এখনি আসছি। ঘর বন্ধ রাখুন, কেউ খুলতে বললেও খুলবেন না। 

তরপর আব্বা ফোন করলেন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ ও আরো কয়েক জায়গায়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর দ্রুত ফোর্স পাঠানোর জন্যে। তড়িঘড়ি করে নিজে তৈরি হলেন। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সিভিল ড্রেসেই রওনা দেবেন। কথাবার্তার শব্দ শুনে পাশের ঘর থেকে আমি ও অমার বড় বোন উঠে এসেছি। 

আব্বা দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছেন। আম্মা একুট বলতে চাইলেন- ‘তোমাকে কি যেতেই হবে?’ আব্বা বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী বলছো তুমি? বঙ্গবন্ধু বিপদে আর আমি আমি যাব না!’ তারপর শুধু বললেন, ‘আমার মেয়েদের দেখে রেখো।’
সকাল হলো। রেডিও তে আমরা শুনলাম খুনিদের সদম্ভ ঘোষণা-‘বঙ্গবন্ধু নিহত’! আব্বার খবর তখনো জানি না। উৎকণ্ঠায় আম্মা নানাদিক ফোন করছেন। ড্রাইভার আইনুদ্দিন ততক্ষণে চলে এসেছেন। কিন্তু কথাই বলতে পারছেনা । শুধু হাইমাউ করে কাঁদছে। দুপুরে জেনারেল সফিউল্লাহ ফোন করলেন, ইতস্তত করছিলেন বলতে, শেষ পর্যন্ত আম্মাকে দিলেন খবরটা- ‘ভাবি, জামিল ভাই আর নেই’। 

সেদিনের ঘটনা আমরা পরবর্তীকালে জেনেছি আইনুদ্দিন চাচা ও সোবহানবাগ মসজিদের ইমামের বয়ানে। আব্বার  গাড়িটা গণভবন থেকে রওনা করে মসজিদের কাছে এসে পৌঁছলে ব্যারিকেডেরমুখে পড়ে। খুনিদের সহযোগী সৈনিকরা তাকে আর সামনে  যেতে দেবে না। কিন্তু আব্বা যাবেনই। বাদানুবাদের এক পর্যায়ে আব্বা নিজেই গাড়ি চালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সহযোগী ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা তখন আব্বাকে গুলি করে। 

দুপুর পর্যন্ত আব্বার লাশ এভাবেই পড়েছিল। বহু দেনদরবার শেষে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মধ্যস্থতায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে বলা হলো লাশ আমরা দেখতে পারবো, তবে শর্ত একটাই- কান্নাকাটি করা চলবে না। মধ্যরাতে আম্মা ও আমরা তিন বোন আব্বাকে শেষবারের মতো দেখলাম বন্দুকের সামনে বসে। আমার বড় বোনের বয়স তখন ১৬ বছর, সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল বলে খুনিদের প্রচণ্ড ধমক-‘ওকে ভেতরে নিয়ে যান’। 

১৫ আগস্ট আব্বার মৃত্যুর খবরটা পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আমাদের জানানো হলো, গণভবনের এ বাড়িটা আমাদের ছাড়তে হবে। এখানে আর থাকা যাবেনা। অথচ এ বাড়িটায় আমাদের কত স্মৃতি! বাড়ির পাশেই বঙ্গবন্ধুর অফিস। বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখেছিও এই গণভবনেই। 

আমার তখন ১১ বছর বয়স। গণভবনের লেকে একদিন সমবয়সী কাজিনরা ছিপ ফেলে মাছ ধরছি। হঠাৎ পেছন থেকে শুনি দরাজ কণ্ঠ--‘কে রে আমার লেকে মাছ ধরে’? তাকিয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু। আমরা তো ছিপটিপ ফেলে ভয়ে দে দৌড়। বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন। গুটি গুটি পায়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই কৃত্রিম চোখ পাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ আমার লেকে মাছ ধরা হচ্ছে’? এরপর বিভিন্ন সময় দেখা হলে অনেক আদর করতেন। 

শীতকালে বিকেলে লেকের পাড়ে বসে চা খেতেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের দেখলেই ডেকে পাশে বসাতেন। বলতেন ‘গান পারিস? দেখি গান কর একটা।’ আমিও শুনিয়ে দিতাম- আমার সকল দুঃখের প্রদীপ....। একবার আমরা ক’জন শিশুশিল্পী বিটিভির একটা অনুষ্ঠানে গান করলাম, সম্মানীর টাকাটা তহবিলে জমা দিলাম। এরকম কত স্মৃতি। 

আব্বা প্রতিদিন সকালে ধানমণ্ডি গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গণভবনে নিয়ে আসতেন। আব্বার অফিস ছিল বঙ্গবন্ধুর অফিস রুমের সাথে লাগোয়া। মাঝখানে একটাই দরজা। এক দৌড়ে আব্বার অফিসে ঢুকে উঁকি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখে চলে আসতাম। আব্বা প্রায়ই আক্ষেপ করতেন-‘বঙ্গবন্ধুকে এত বলছি গণভবনে চলে আসতে কিন্তু তিনি একদম শুনছেন না আমার কতা। এখানে কিছু হলে আমরা নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে পারবো।’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘তুই কী বলিস জামিল! আমাকে কে মারবে? আর আমি জনগণের মানুষ, আমি এখানে এসে থাকতে পারব না’। 

শেষের দিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার অনেক চেষ্টা ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসব শুনতে চাইতেন না। আব্বা তখন দুঃখ করে বলতেন, ‘ বঙ্গবন্ধুর বুকে একটা গুলি লাগবে আর অমার বুকে একটা’। এটাই হলো শেষ পর্যন্ত। 
এরপর খুব দুঃসময় গেছে আমাদের। সর্বত্রই তখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা, আর বঙ্গুবন্ধকে বাঁচাতে গিয়ে আমার আব্বা মারা গেছে! কাউকে বলতে পারি না, কোথাও যেতে পারিনা। স্কুল যেতে ভালো লাগত না।-বন্ধুরা কী বলবে!
এদিকে আব্বার যেদিন চল্লিশা হলো সেদিনই আম্মা টের পেলেন -গর্ভে তার চতুর্থ সন্তান! আট মাস পর আমাদের সেই বোনের জন্ম হলো। আব্বার পেনশন -প্রভিডেন্ট ফান্ড তুলতে গেলে আম্মাকে বলা হলো- টাকা পেতে হলে আগে এ মর্মে সই দিতে হবে যে, কর্নেল জামিল ক্রসফায়ালে মারা গেছেন। আম্মা রাজি হলেন না। তখন কটাক্ষ করে বলেছে-‘যাদের জন্যে জান দিয়েছে  তাদের কাছে যান না কেন? ওদের কাছে গিয়ে সাহায্য চান।’

এমন বহু তিক্ত পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হয়েছে সে সময়। কিন্তু আজ শুকরিয়া আদায় করি, অনেক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আম্মা আনজুমান আরা জামিল আমাদের চার বোনকে মানুষ করেছেন। সুন্দরভাবে জীবনযাপনের জন্য সেদিন হয়তো আমাদের অনেক কিছুরই প্রয়োজন ছিল, কিন্তু প্রয়োজনটাকে আমরা প্রয়োজন মনে করেছি। কখনো সেটাকে লোভে পরিণত করিনি। 

সবচেয়ে বড় কথা, বুঝতে শেখার পর থেকে আমরা কখনো আব্বার মৃত্যু নিয়ে পরিতাপ করিনি-লোকটা এভাবে মরে গেল! জীবন দিয়ে দিল? বরং সবসময় গর্বিত হয়েছি- বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে আব্বা শহিদ হয়েছেন। কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাননি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তার দায়িত্ব পালনে। এটাই আমাদের সাহস দিয়েছে সব বাধা ঠেলে এগিয়ে যেতে।

এই ইতিবাচকতা শিক্ষাই আরো পূর্ণাঙ্গভাবে পেলাম কোয়াণ্টামে এসে। আব্বা মারা যাওয়ার পর কত রকম বিপর্যয়ের ভেতর আমরা বেড়ে উঠেছি, কিন্তু আমাদের সাইকোথেরাপি-কাউন্সেলিং কিছুই হয়নি। কোয়াণ্টাম মেথড কোর্সে পারিবারিক মেডিটেশন যখন মা-বাবাকে অনুভব করা এবং তাদের জন্যে দোয়া করতে বলা হলো তখন খুব কাঁদলাম। আব্বা- আম্মাকে জড়িয়ে ধরে যে অনুভূতি আমার হলো, সেটা বলে বোঝাতে পারবোনা। এত বছরের জমে থাকা ক্ষোভ-দুঃখ ঘৃণা অনেকটাই দূর হয়ে বেশ হালকা মনে হলো নিজেকে। 

সবমিলিয়ে কোয়াণ্টাম মেথড একটা অসাধরণ কোর্স। কোরআনকে ভিত্তি করে এর পুরো বিষয়বস্তু, সেই সাথে অনান্য ধর্মের নৈতিক শিক্ষা ও মনীষীদের কথাগুলোও খুব সুন্দরভাবে এখানে সংকলিত হয়েছে। গুরুজীর কথা ও মেডিটেশন এত বছর পর আমার জন্যে একটা সাইকোথেরাপির মতোই কাজ করেছে। কোয়াণ্টাম আমার জীবনে এনে দিয়েছে নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরণা। 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি